আজ ২৮শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৩ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আধ্যাত্মিক সাধনা ও সুফি সাহিত্যিকের বাতিঘর: শাহ্ আলী রজা ওরফে কানু শাহ্ (রহ.)

Spread the love

মো. আমজাদ হোসেন,আনোয়ারা: সবুজে ঘেরা চট্টগ্রামের পাহাড়-পর্বত, বনে-জঙ্গলে, নদী-সমুদ্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন অসংখ্য পীর, আউলিয়া ও সুফি দরবেশ। তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত দরবার শরীফগুলো আজও মানুষের আত্মিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক সাধনার আশ্রয়স্থল। তেমনই এক পবিত্র স্থান হলো চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ৯নং পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওষখাইন আলী নগর দরবার শরীফ—যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সুফিবাদের ঐতিহ্য ধারণ করে আসছে।

এই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত শাহ্ আলী রজা (রহ.), যিনি “কানু শাহ্” নামে সমধিক পরিচিত। তিনি ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে (১৭ শ্রাবণ ১১৬৫ বঙ্গাব্দ) ওষখাইন গ্রামে আগমন করেন। ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর ছিদ্দীক (রাদ্বি.)-এর বংশধর এই মনীষী শৈশব থেকেই নামাজ, রোজা, কুরআন শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতায় ডুবে ছিলেন।

পিতার ইন্তেকালের পর মাতার তত্ত্বাবধানে শিক্ষাজীবন চললেও পরবর্তীতে সুফি দরবেশ শাহ্ সূফি শায়েখ কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)-এর সংস্পর্শে এসে শরিয়ত, ত্বরিকত ও তাসাউফে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি কেবল আধ্যাত্মিক সাধকই নন, ছিলেন এক অনন্য দার্শনিক, কবি ও বহু ভাষাবিদ। বাংলা, ফারসি, আরবি, সংস্কৃত ও দেবনাগরী ভাষায় রচিত তাঁর অজস্র গ্রন্থে সুফিবাদের গভীর দর্শন প্রকাশ পেয়েছে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে— গোপ্ত তত্ত্বের আগম, জ্ঞানসাগর, সিরাজ কুলুব, যোগ কালন্দর, ইসলামনামা, ষঠচক্র ভেদ এবং রফিকুচ্ছালেকীন। তাঁর লেখা “মনের মহিমা” নামে একটি আধ্যাত্মিক কবিতা ১৯৬৬/৬৭ শিক্ষাবর্ষে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম ‘জ্ঞানসাগর’ গ্রন্থটি একাধারে বাংলা ভাষা ও সুফি দর্শনের অমূল্য সম্পদ। ১৯১৭ সালে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সম্পাদনায় এর অংশবিশেষ প্রকাশিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে। পরে ড. আহমদ শরীফ তাঁর “বাঙলার সুফি সাহিত্য” গ্রন্থে এর পূর্ণ রূপ প্রকাশ করেন।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘জ্ঞানসাগর’-এর ইংরেজি অনুবাদ The Ocean of Love নামে প্রকাশ করেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ডেভিড জি ক্যাসিন। বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য তিনি ছয় বছর বাংলাদেশে অবস্থান করেন। তাঁর মতে, মুসলিম সুফি কবিদের সাহিত্যিক অবদান যথার্থভাবে মূল্যায়িত হয়নি এবং শাহ্ আলী রজা (রহ.)-এর মতো সুফি কবিদের সাহিত্য বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা জরুরি।

সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক সাধনার পাশাপাশি তিনি চিশতিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দিয়া ও সরওয়ার্দিয়া ত্বরিকার খলিফা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জীবনের ৩৬টি বছর নির্জন বন-জঙ্গলে রিয়াজতে কাটান এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত খানকাহে মুরিদদের আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ দেন।

তাঁর নির্দেশিত “বিষু মোবারক” নামক এক বিশেষ তাসাউফী সাধনার পন্থা আজও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা চর্চিত। প্রতি বছর বাংলা সনের আষাঢ় ও পৌষ মাসে তিনদিনব্যাপী এই সাধনা অনুষ্ঠিত হয় ওষখাইন আলী নগর দরবার শরীফে এবং অনুসারীদের নিজ নিজ এলাকাতেও।

এই মহান সাধক ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে, বুধবার, ৭৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাজার শরীফ এখন লাখো ভক্তের মিলনকেন্দ্র। প্রতি বছর বাংলা সনের পৌষ মাসের শেষ তারিখে এখানে ‘বিষু’ ও বার্ষিক ওরশ শরীফ গভীর ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয়।

হযরত শাহ্ আলী রজা কানু শাহ্ (রহ.)-এর বংশধর পীরজাদা হাফেজ মৌলানা নিজাম উদ্দীন ছিদ্দিকী এই তথ্যসমূহ সত্যায়ন করেছেন এবং বলেন, “বাংলাদেশ সরকার তাঁর লেখা আধ্যাত্মিক কবিতা ‘মনের মহিমা’ পুনরায় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত এবং ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল তাঁর নামে নামকরণ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে আধ্যাত্মিকতা ও মানবিক প্রেমের বাণী পৌঁছে দিতে পারে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর